সাহিত্য

    বাংলা ভাষার কিছু কথা
এস এম নাজমুল হক ইমন :: ভাষা হলো আত্মার আয়না। যার মাধ্যমেই মানুষ বাঙময় স্বনির্ভর সংকেতধর্মী প্রকাশ ঘটিয়ে সামাজিক আদান-প্রদান করে থাকে। ভাষা মূলত সাংকেতিক ধ্বনিগুলোর মধ্যেও একটি রীতিনীতি পালন করতে হয়-শুধু অক্ষরগুচ্ছ এলোমেলোভাবে সাজিয়ে গেলে তা যদি কোনো ভাষা চিহ্ন প্রকাশে সহায়ক না হয়, তাহলে এগুলো কোনো ভাষা চিহ্ন হিসেবে পরিগনিত হতে পারে না।
এ জন্যই বাগধারা থেকে অর্থপূর্ন অংশকে যদি এর দেহ বলা হয় তাহলে এর অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যঞ্জনাকে আত্মা হিসেবে মেনে নিতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রেখেই বোধ হয় শব্দ আমাদের কাছে শুধু বস্ততর শব্দ চিত্র নয়, উপলব্দির চিত্রকল্প এবং ভাবজগতের চলমান ছবিও বটে। ভাষা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জড়জগতের নিরবয়র ধারার প্রতীক। এই প্রতীকগুলো স্বনির্ভর এবং এর নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। ভাষার লক্ষন হলো এটা বাঙময়, এর অর্থবহ প্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে। ইঙ্গিত, লিপি দ্বারা রচিত অথবা বিশেষ কোনো চিহ্নের দ্বারা। অবশ্য এই ইঙ্গিত যেমনই হোক অথবা যে কোনো ভাষার গঠন প্রনালীর হোক-তার মধ্যে অবশ্যই নিজস্ব শৃঙ্খলা রীতির একটি ব্যাপার থাকে, যা গানিতিক সূত্রের মতোই অবধারিত। এ জন্য ভাষার বিবর্তনও মূলত আবেগপ্রবন মনের প্রতিফলন। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার ভাষা আছে। এই ভাষাগুলোর প্রায় ছাব্বিশটি ভাষাগোষ্ঠী রয়েছে। এই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে পৃথিবীর এই বিপুলসংখ্যক ভাষার যোগসূত্র নির্ণয়ের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছেন ভাষাতাত্ত্বি¡কেরা। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যেই কোন ভাষা কোন ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল সেটা নির্ণয় করা, অথবা ভাষাগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত একাধিক ভাষার মধ্যে কোনোটি বিলুপ্ত হয়ে থাকলে ওই ভাষাকে সমগোত্রীয় বলে বিবেচনা করা। সর্বশেষ কবে ভাষার বিবর্তন এবং বিলুপ্তির ক্ষেত্রে ওই ভাষার রচনা এবং শিলালিপি ঐতিহাসিক প্রমান হিসেবে আলোচনায় আসতে পারে। বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল, বিবর্তন এবং এর বিস্তারলাভ সম্পর্কে এখানে সামান্য আলোকপাত করা হবে। সংক্ষিপ্ত এবং কিছুটা বিক্ষিপ্ত মনে হলেও এতে বাংলা ভাষার একটি অনুচিত্র দেখা যাবে। বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল নিয়ে নানামুনীর নানা মত থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিতই মনে করেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তি দশম শতাব্দীতে। আর্য ভাষাগোষ্ঠী থেকে বাংলা ভাষা এসেছে। আর্য ভাষার প্রাচীন যে নিদর্শন ঋগবেদে পাওয়া যায়, তা থেকেই পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, বাংলা ভাষা আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই লতিয়ে লতিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই ধারনাটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আদি, মধ্য ও নব্য বা আধুনিক বাংলার স্তর বিন্যাস করতে গিয়ে ৯৫০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৩৫০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আদি ও মধ্য বাংলার কাল নির্ণয় করা যায়। বডু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের পুঁথি খুব বেশি প্রাচীন না হলেও  এতে আদি মধ্য বাংলা ভাষার নমুনা পাওয়া যায়। অবশ্য এর পরও প্রায় ২০০ বছর বাংলা ভাষার সাহিত্য চর্চা এই নমুনাকে আশ্রয় করেই চলতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে বাংলা ভাষা বাঁক নেয়, আর এখান থেকেই আধুনিক বাংলা ভাষার যাত্রা শুরু হয়। উচ্চারন বৈশিষ্ট্যে বাংলা ভাষার ধ্বনি দুই প্রকার। স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি-সংস্কৃত স্বরধ্বনি কিছুটা হেরফের হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে। সংস্কৃত আ দীর্ঘ ধ্বনি বাংলায় এসে এর ধ্বনিরূপ হয়েছে হ্রস্ব। একইভাবে বাংলার ই,ঈ, উ, ঊ ধ্বনিগুলো শব্দে সংস্কৃতের মতো উচ্চারন হয় না। বরং বাংলায় একটি নতুন স্বরধ্বনি সৃষ্টি হয়েছে-অ্যা। সংস্কৃত ও বাংলায় লিঙ্গ বিচারেও পার্থক্য রয়েছে, প্রাচীন বাংলায় স্ত্রী লিঙ্গে স্ত্রী প্রত্যয় চলত-আধুনিক বাংলায় এর ব্যবহার লোপ পেয়েছে। সংস্কৃতের মতো কারক ও বিভক্তির ক্ষেত্রে প্রাচীন এবং আধুনিক বাংলায় একই ধারা লক্ষ্য করি আমরা। প্রাচীন বাংলায় কারক ছয়টি-কর্তা, কর্ম, করণ, অপাদান, অধিকরণ ও সম্বন্ধ। আধুনিক বাংলা ভাষায় কারকের ব্যবহার হয় চারটি-কর্তা, কর্ম, করণ-অধিকরণ ও সম্বন্ধ। অবশ্য বাংলা ভাষার অধিকাংশ ধাতু সংস্কৃত থেকে এসেছে। উৎপত্তির দিক থেকে বাংলায় মৌলিক কাল দুটি-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। প্রাচীন বাংলায় যৌগিক ক্রিয়া দেখা গেলেও যৌগিক কালের কোনো উদাহরন পাওয়া যায় না। বাক্য গঠনের দিক দিয়ে বাংলায় উদ্দেশ্য প্রথমে বসে এবং বিধেয় বসে পরে। প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ উক্তি বাংলায় বর্ননামূলক বাক্যে ব্যবহার করা হয়। বাংলা ভাষার অনেক আগন্তক শব্দের আগমন ঘটেছে। শব্দের মধ্যে অস্টিক-দ্রাবিড় ও ইন্দো ইউরোপীয় ভাষার শব্দগুলো লক্ষনীয়ভাবে চোখে পড়ে। অশোকের কয়েক শতাব্দী আগে ব্রাক্ষীলিপির উদ্ভব হয়েছিল বলে পণ্ডিতরা অনুমান করেন। অবশ্য সরাসরি ব্রাক্ষীলিপি থেকে বাংলালিপি আসেনি, বিভিন্ন সময় পরিবর্তন এবং পরিশীলনের মাধ্যমে এগুলো বাংলালিপির রূপ নেয়। ব্রাক্ষীলিপির পরিবর্তন সূচনা হয় কুষান রাজত্বকালে-চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে এবং অচল ভেদে ব্রাক্ষীলিপির পরিবর্তন দেখা যায়-উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ব্রাক্ষীলিপির তিনটি পরিবর্তন রূপ পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। এর মধ্যে শারদা, নাগর, এবং কুটিল। কুটিললিপি থেকে বাংলালিপির উদ্ভব হয়।
এসো মিলে গড়ি খেলাঘর
শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম :: ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হবার পর সরকারিভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়ানো শুরু হয়েছিল। বাঙ্গালির অধিকার নিয়ে চলছিল ছিনিমিনি খেলা। বাংলা ভাষার অধিকার পদদলিত করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। 
কিন্তু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলার ছাত্র- তরুণেরা। জন্ম দিয়েছিল ভাষা আন্দোলনের। এই আন্দোলন মানুষের মধ্যে নতুন চেতনা ও আশার সঞ্চার করে। সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসে বাঙ্গালির জাগরন ঘটে।  ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে দৈনিক সংবাদ পত্রিকাকে ঘিরে জন্ম নেয় জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর এর। 
পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী  আরবি-ফার্সি শব্দ চালু করার যে জোর প্রয়াস চালাচ্ছিল তার বিপরীতে পত্রিকায় খেলাঘর  নামে শিশু কিশোরদের পাতা প্রবর্তন করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা হয়। খেলাঘরের জন্ম হয় শিশুদের মানবিক বিকাশের আলোকস্পর্শে জাগিয়ে তোলার জন্য। শিশুরা যে জাতির ভবিষ্যৎ এবং তাদের চিত্তের জাগরণ ঘটানো যে আবশ্যম্ভাবী  তা খেলাঘরই উপলদ্ধি করতে পেরেছিল। ১৯৫২ সালের ২ মে কবি হাবীবুর রহমানের পরিচালনায় দৈনিক সংবাদে খেলাঘর পাতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনটির সূচনা হয়। ১৯৫৪ সালে এই সংগঠনের বিভিন্ন শাখা আসর গঠন শুরু করা হয়। সে থেকে  খেলাঘর নিরবচ্ছিন্নভাবে পথ চলে আসছে।
খেলাঘর মনে করে শিশুর যথাযথ পরিচর্যা, অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের মেধা ও মননের বিকাশ সাধনের মাধ্যমে একটি প্রগতিশীল প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কারণ আজকের শিশুই যে আগামীর ভবিষ্যৎ। তাইতো কবি বলেছেন, ‘ ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’।
শিশু মায়ের গর্ভ থেকে নিয়ে আসা মস্তিস্কের কোষ মাত্র ৫ বছরের মধ্যে কার্যকর সংযোগ দান করতে পারে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ বছরে ৮০ ভাগ, ৫ বছরে ৯০ ভাগ এবং ১১ বছরে ১০০ ভাগ সংযোগ সাধিত হয়ে থাকে। তাই শিশুদের জন্য এই সময়গুলো খুবই গুরত্বপূর্ণ। এই সময়ের ভেতর শিশুকে যে মানসিক চেতনায় প্রলুব্ধ করা যায় সে পরবর্তীতে সেভাবেই বড় হয়। তাই খেলাঘর তাদের ঘোষণাপত্রে বলেছে, শিশুরা বিশ্বের আলো, কিশোররা আগামী দিনের কর্ণধার। শিশু-কিশোরদের আগামীদিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের শরীর ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশ প্রয়োজন। খেলাঘর শিশুর শরীর গঠনের জন্য খেলাধুলার পক্ষপাতি। পাশাপাশি তাদের সুকুমার বৃত্তিসমূহের বিকাশের জন্য সবধরনের সৃজনশীল কর্মকান্ডে উৎসাহী।  শিশুদের দৈহিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা যেমন দরকার তেমনি দরকার সুষম খাদ্য, মুক্ত আলো-বাতাস, সংস্কারমুক্ত উদার পরিবেশ। অন্ধবিশ্বাস, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা বর্জন এবং বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে সেই কাংখিত পরিবেশ। খেলাঘর তাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ও বিজ্ঞানচর্চায় বিশ্বাসী।
 মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালবাসা, পৃথিবীর সব শান্তিকামি মানুষের সাথে একাতœ হওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা, কুচকাওয়াজ, দৌড়-ঝাঁপ, সাঁতারসহ সব ধরনের আনন্দদায়ক ও মৌসুমি খেলাধুলার ব্যবস্থা করা, সাহিত্যবাসর ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন, দেয়াল পত্রিকা, স্মরণিকা, কিশোর পত্রিকা প্রকাশ, আবৃত্তি, অভিনয়, নাচ, ছবি আাঁকা, হাতের কাজ এবং গান শেখার ব্যবস্থা করা, পাঠাগার স্থাপন, নিরক্ষরতা দূর করা, নিজের লেখাপড়ার মান উন্নয়ন এবং বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় সহযোগিতা করা, দেশ ও সমাজের জন্য সেবামূলক কাজ করা, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের জন্য সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা নেয়া এবং দুঃস্থ শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহন খেলাঘরের ঘোষণাপত্র স্বীকৃত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপানুযায়ী দেশে মোট শিশুর সংখ্যা ৫১ দশমিক ৫ মিলিয়ন। এদের মধ্যে শিশু শ্রমে নিয়োজিত ৬ দশমিক ১ মিলিয়ন। শিশু শ্রমিকদের ৫৬ ভাগ ভাসমান। দিনে তিন বেলা খাবার পায় ৪৭ ভাগ শিশু শ্রমিক। ৬১ ভাগ শিশু শ্রমিক দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী। শিশুদের মধ্যে যারা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে যায়, তাদের মধ্যে বিরাট অংশই শিক্ষা শেষের আগে ঝড়ে পড়ে।
খেলাঘর নিয়মিত কর্মসূচিভিত্তিক একটি জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন হিসেবে একটি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর অগ্রপথিক ছিলেন শ্রদ্ধেয় কবি হাবীবুর রহমান, কমরেড মনিসিংহ, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, রনেশ দাসগুপ্ত, সত্যেন সেন, জহির রায়হান, কাজী ইদ্রিস, বজলুর রহমান, মতিয়া চৌধুরী, কমরেড সালাম, কমরেড হালিম, কমরেড অনিল, কমরেড ফরহাদ। আর এই আন্দোলনের নাম ‘ এসো গড়ি খেলাঘর, এসো গড়ি বাংলাদেশ‘।
খেলাঘর আসরের আজকের ম্লোগাণ হচ্ছে, ‘ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তোল‘। মহান মুক্তিযুদ্ধে খেলাঘরের কর্মীররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছিল। যুদ্ধে ৮ জন খেলাঘর কর্মী শহীদও হন। তারই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি খেলাঘরেরও প্রাণের দাবি। বর্তমান সরকার এই কাজটি ইতিমধ্যেই শুরু করেছে। শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতারও করা হয়েছে। এই মুহূর্তে একটি চিহ্নিত শক্তি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের ধোয়া তুলে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। যাতে বিচার প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। খেলাঘরের প্রতিটি কর্মীকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার যে স্বাধীনতা এসেছে তাকে সমুন্নত রাখতেই হবে। আবার কোন বেনিয়া এসে ধান শালুকের এই দেশটাকে যেন কুরুক্ষেত্রে রূপান্তর করতে না পারে সেজন্য সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
লেখক :: সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক আমার চাঁদপুর।
সেকালের চিঠি একালের চিঠি
নাজমুল ইসলাম মকবুল :: এককালে দেশবিদেশে স্বজনদের সাথে যোগাযোগ ও কুশলবিনিময়ের সর্বোত্তম ও বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে চিঠি লেখার এবং চিঠি আদান প্রদানের ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ ছিল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। প্রাচীন আমলের রাজা বাদশাহরাও দূত মারফত বিভিন্ন রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান বা অধীনস্থ রাজ্যপ্রধানদের সাথে একমাত্র চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে বর্তমান ইন্টারনেট ইমেইল ফোন ও মোবাইলের যুগে আজ তা ক্রমশঃ হারিয়ে যাবার পথে। জাদুঘরের বন্ধ খাচার দিকে ক্রমশঃ ধাবমান আর ইতিহাসের পাতায় বন্দি হওয়ার মতো অবস্থা। ই-মেইল, ফেইসবুক, চ্যাটিং,  এসএমএস, মাল্টিমিডিয়া ম্যাসেজ, ফ্লাশ ম্যাসেজ, অডিও ম্যাসেজ, টেলিকানেকশন, ও মোবাইলের জয়জয়কারে দেশে বিদেশের স্বজনদের সাথে পত্রযোগাযোগ এখন সেকেলে মডেলে পরিণত হয়েছে। এই ক’বছর পূর্বেও সিলেটসহ সারাদেশেই পোষ্ট অফিসের ডাকপিয়নের কদর ছিল আকাশচুম্বি। ডাকঘর খোলার অনেক পূর্ব থেকেই সর্বসাধারনের দারুন ভীড় দেখা যেতো পোস্ট অফিসের আঙ্গিনায়। অনেকেই বসে বসেই প্রতিক্ষার প্রহর গুণতেন কবে কখন আসবেন ডাক পিয়ন। ডাকপিয়ন এসে অফিস খোলার পরেই ডাকে আসা চিঠি বের করে সিল মেরে এক একটি চিঠি হাতে নিয়ে এয়ারলেটার বা খামের উপর উলেখিত প্রাপকের নামে নাম ধরে ধরে উচ্চস্বরে ডাকতেন। তখন সেখানে উপস্থিত লোকজন নিজ নিজ চিঠি আত্মীয়দের চিঠি বা পাশের বাড়ীর চিঠি নিজ হাতে সমঝে নিয়ে যেতেন বাড়ীতে। বাড়ীতে যাবার পর চিঠি খুলে সকলেই খুশিতে জড়ো হয়ে পড়া শুনতেন। পড়া জানা না থাকলে পাশের বাড়ীর কোন পড়া জানাশুনা ব্যক্তির নিকট গিয়ে চিঠি পড়া শুনে তার মর্ম অবগত হতেন। সমস্যা হতো স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেয়া চিঠি পড়াতে বা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে দেয়া চিঠি লেখাতে। তখন পাঠক বা লেখক খোজা হতো নিতান্ত আপনজনকে। কারন স্বামী স্ত্রীকে যে মধুমাখা আবেগ দ্বারা চিঠি দিতেন তা সকলের দ্বারা পাঠ করানো সম্ভব হতোনা এজন্য যে, এতে স্ত্রীর লজ্জা শরমের একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। আগেকার যুগে পাড়া মহলায় চিঠি লেখকদের যথেষ্ট কদর ছিল। যারা চিঠি লেখাতেন বা পাঠ করাতেন তারা এদেরকে সব সময় সমীহ করে চলতেন এবং সময় সুযোগমতো দাওয়াতও খাওয়াতেন। প্রেরক চিঠি লেখকের বাড়ী বারবার হানা দিতেন একটা চিঠি লেখানোর জন্য। চিঠি লেখক ব্যস্ত থাকলে বলতেন আগামীকাল, পরশু অথবা রাত্রে সুবিধাজনক সময়ে আসেন। এভাবে অনেক সময় চিঠি লেখকের বাড়ীতে বারবার চক্কর দিয়ে অনুনয় বিনয় করতে হতো একটি চিঠি লেখানোর জন্য। চিঠি লেখানোর সময় লেখককে আঞ্চলিক ভাষায় পুরো বিষয়আশয় বলা হতো তখন তিনি সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতেন। আবার কেহবা একটু একটু করে বলতেন এবং লেখক তা খুটিয়ে খুটিয়ে লিখতেন। কিছু অংশ লিখার পর প্রেরককে পাঠ করে শুনাতেন। চিঠির প্রথমে ‘‘এলাহী ভরসা, আলাহ মহান, আলাহ সর্বশক্তিমান, ৭৮৬/৯২’’ ইত্যাদি লেখা হতো। এরপর প্রাপককে সম্বোধন  করা হতো বিভিন্ন মায়াবী ভাষায়। যেমন ছেলে পিতাকে লিখলে পরম শ্রদ্ধেয় আব্বা, জনাব আব্বাজান সাহেব, জনাব বাবাজান, শ্রদ্ধেয় বাবাজী ইত্যাদি, স্ত্রী স্বামীকে লিখলে প্রাণপ্রিয় স্বামী, ওগো আমার পরানের স্বামী, ওগো আমার জীবন সাথী ইত্যাদি।  এরপর লিখা হতো লিপির শুরুতে আমার হাজার হাজার সালাম নিবেন, ছোট হলে দোয়া পর সমচার এই যে আশা করি বাড়ীর সকলকে নিয়ে কুশলেই আছো ........। অনেকেই প্রতিটি প্যারাতে আর এর পরিবর্তে সংক্ষেপে বা ষ্টাইলের জন্য ইংরেজীতে জ লিখতেন, ইতি লেখার সময় ঊ তি লিখতেন। আগেকার যুগে প্রেমিক প্রেমিকার যোগাযোগ বা প্রেম নিবেদনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুলপ্রচলিত মাধ্যমও ছিল চিঠি আদান প্রদান। এতে নানা ধরনের মুখরোচক ও আবেগময় লিখা থাকতো যেমন ‘‘ও আমার পরান পাখি, ও আমার জানের জান............. ’’। প্রেমের চিঠি আদান প্রদানের সময় বন্ধু বা বান্ধবীর প্রতিবেশি বা সমমনা বন্ধু বান্ধব অথবা বাড়ির ছোট ছোট ইচড়েপাকা কিশোর কিশোরিকে ব্যবহার করা হতো এবং এ কাজের জন্য তাদেরকে নানান ধরনের পুরস্কারেও ভুষিত করা হতো। প্রেমিক বা প্রেমিকা চিঠি পেয়ে সাড়া দিলে তখনি চিঠির উত্তর দিয়ে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে প্রেমের প্রথম পর্ব শুরু হতো। আবার অনেকে প্রেম প্রত্যাখ্যান করলে চিঠি ছিড়ে ফেলতো। বাহকের কাছ থেকে যেকোনভাবে জায়গামতো না গিয়ে অভিভাবক বা মুরব্বী কারো হাতে গেলে বিচার আচার কিংবা ঝগড়া ঝাটি মারামারিও হতো। অনেকেই নিজে চিঠি লিখার বা লিখানোর পরও বারবার পাঠ করে শুনতেন বা শুনাতেন যাতে কোন তথ্য অসম্পূর্ণ না থাকে। এভাবে ব্যক্তিগত পারিবারিক ও অন্যান্য খবরাখবর এবং আশয়বিষয় লেখার পরও প্রেরকের মধ্যে না বলার বা না লেখার অতৃপ্তি মনের মধ্যে থেকেই যেতো। কি জানি কোন তথ্য বাদ গেলো এ নিয়ে অনেকেই গভীর চিন্তা করতেও দেখা যেতো। দেশ বিদেশের বিষয়আশয় জানার জন্য প্রবাসীদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বহুল প্রচলিত মাধ্যম ছিল চিঠি আদান প্রদান। চিঠির মাধ্যমে প্রবাস থেকে বিস্তারিত হাল হকিকত জানানো হতো সপ্তাহে পনের দিনে কিংবা মাসে অন্তত একবার। এতে লেখা থাকতো ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে সাংসারিক পারিবারিক সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক অনেক সংবাদ। নব্বই দশকের পূর্ব থেকেই দেশের প্রতিটি জেলা সদর এবং পর্য্যয়ক্রমে বিভিন্ন উপজেলা সদরে ডিজিটাল টেলিফোন ব্যবস্থার সুবাদে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, ইউরোপের প্রায় সকল দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের প্রবাসীদের সাথে সরাসরি ফোনে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু মিনিটে স্থানভেদে একশত থেকে দেড়শত টাকা করে বিল আসায় নিতান্ত অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেহ টেলিফোন করতেননা। তাও দ’ু চার মিনিটের মধ্যেই আলাপ সীমাবদ্ধ থাকতো। দীর্ঘ আলাপ হলে রিভার্স কল করা হতো যাতে প্রবাসীকে কল ব্যাকের ম্যাসেজ দেয়া হতো, কল আসলে রিভার্স কলের বিল দেয়া হতো। এছাড়া এরও পূর্বে অতি জরুরী খবর পৌছানোর জন্য টেলিগ্রামের প্রচলন ছিল। টেলিগ্রাম সম্পর্কিত পুরনো একটি জনপ্রিয় গানও আছে ‘‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম, বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌছাইতাম....’’।
বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বল্প খরছে চেটিং করা যায়। ফেইসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা বাতচিত করা যায়। চার পাঁচ টাকা মিনিটে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের প্রায় সকল দেশেই ফোন করা যায়। নেট কলিং কার্ড মোবাইলে ঢুকিয়ে নিজ মোবাইলের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে আলাপ করা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। এছাড়া মোবাইলের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কলচার্জ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় অনেকেই নিজের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি ফোন করে ভাবের আদান প্রদান করেন হরহামেশাই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রবাসীরা বিদেশ থেকে ইন্টারনেট কার্ডের মাধ্যমে দেশে স্বজনদের মোবাইলে বা ফোনে আলাপ করেন ঘন্টার পর ঘন্টা। প্রবাসীদের সাথে আলাপ করে জানা যায় পাঁচ পাউন্ডের কার্ডের মাধ্যমে তারা প্রায় ঘন্টা দেড়েক আলাপ করতে পারেন। তাইতো প্রবাসীরা ফোন করলে আর রাখতে চাননা। অপ্রয়োজনীয় গল্প গুজবেও তাদের লিপ্ত হতে দেখা যায়। বর্তমানে কী তরকারি পাকানো হচ্ছে, তরকারিতে লবন বেশি হলো না কম হলো, ঝাল কেমন হলো, রাতে ঘুম কেমন হয়েছে, পাশের বাড়ির অমুকের মা কি করতেছেন, বাচ্ছায় হাসছে না কাঁদছে ইত্যাদি আলাপও বাদ যায় না ফোনের মাধ্যমে। অনেকে টেলিফোনে শিশুর অস্পষ্ট আলাপ বা হাসি কান্না শুনান। এছাড়া রাজনীতি সচেতন প্রবাসীরা রাজনীতিরও খবরাখবর নিচ্ছেন হরদম টেলিফোন বা মোবাইলের মাধ্যমে। অনেক নেতা বিদেশে থেকেও দলকে টেলিফোনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করার কথা শুনা যায় এবং এ ব্যাপারে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা লেখিও হয় বিস্তর। নির্বাচনের সময় দলের শীর্ষ নেতা নেত্রী থেকে শুরু করে মাঝারী ধরনের নেতা নেত্রীরা পর্যন্ত সময় স্বল্পতার কারনে বিভিন্ন এলাকায় স্বশরীরে উপস্থিত হতে না পেরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভাষন প্রদান ও ভোট প্রার্থনার একটা রেওয়াজও সৃষ্টি হয়েছে গত ক’বছর ধরে। এছাড়া প্রার্থীরা একসময়ে কয়েক জায়গায় যেতে না পেরে মোবাইলের মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন ভোটারদের উদ্দেশ্যে আর তা স্পীকারের বা মাইকের মাধ্যমে শুনানো হয় সমর্থকদের। এছাড়া সরাসরি মোবাইলে ফোন করে বা এস এম এস করে সালাম জানিয়ে ভোট প্রার্থনারও রেওয়াজ সৃষ্টি হয়েছে। ঈদের সময় সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের মোবাইল নাম্বার খুজে খুজে ঈদের সালাম ও শুভেচ্ছা পাঠান এসএমএসের মাধ্যমে, যাতে ভোটের সময় স্মরন হয় লিডারের এসএমএসের কথাটা। বর্তমানে ব্যক্তিগত মোবাইলের ছড়াছড়ির কারনে কপোত কপোতি বন্ধু বান্ধব সহপাঠি শালি-দুলাভাই কিংবা দেবর-ভাবীর রাসালাপও হয় হরদম। মোবাইল বা ফেইসবুকের মাধ্যমে প্রেম অতঃপর পরিচয়, পরিচয় থেকে পরিণয় কিংবা প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে দেদারছে। বিয়ের আকদ (ইজাব কবুল) ও ফোনে হয় অহরহ। এছাড়া টেলিফোনের মাধ্যমে খতম বা মীলাদ শরিফের দোয়ায় শরিক এমনকি জানাযার নামায ও দোয়ায় শরিক হতেও দেখা যায়। যাদের বাড়ীতে আই এস ডি টেলিফোন সংযোগ নেই তাদেরও কোন ভাবনা নেই স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায় আই এস ডি মোবাইলের সীম। অথবা দেশের যে কোন মোবাইল থেকে প্রবাসীর কাছে মূহুর্তে এসএমএস পাঠানো যায় ‘‘পিজ কল ব্যাক’’। তখন প্রবাসীরা সাথে সাথে অথবা সময় সুযোগমতো কল ব্যাক করেন। প্রবাসীরা বর্তমানে দেশে রেমিটেন্সও পাঠাতে পারেন মুহুর্তে। মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেন টাকা পাঠানোর খবর ও পিন নম্বর। মুহুর্তে ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে আনা যায় অনায়াসে। এছাড়া মোবাইল র‌্যামিটেন্সতো আছেই। আগের যুগে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেলে পাত্রী চিঠি পত্র লিখতে পারে কিনা যাচাই করা হতো এমনকি হাতের লেখাও দেখা হতো সুন্দর কী না। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কনে কম্পিউটারে কতটুকু পারদর্শি তা জানার রেওয়াজ এসে গেছে। হাতের মাধ্যমে চিঠি লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় না লিখে লিখে অনেকেরই হাতের লেখা বসে যাচ্ছে অথবা হাতের লেখা ঝালাই দিতে পারছেননা। আর ডিজিটাল এ যুগে ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি লেখার অভ্যাস ॥
লেখকঃ সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম।

বসতি যখন মাটির নিচে

এস এম নাজমুল হক ইমন :: আদি মানব গুহায় বসবাস করত। প্রকৃতি আর হিংস্র জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচতে মাটির নিচে তারা গুহা বানাত। প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতার এই যুগেও মাটির নিচে বসবাস অবাস্তব শোনালেও বিষয়টি শতভাগ সত্য। অস্ট্রেলিয়ার একটি অঞ্চলের অধিবাসী এখনো মাটির নিচে বসবাস করে।
জায়গাটার নাম ক্যুবার পেডি। এটি হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র মাটির তলার নগরী। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত নগরী অ্যাডিলেড থেকে প্রায় ৮০০ কি. মি. দূরে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের মরুভূমিতে ক্যুবার পেডি অবস্থিত। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ক্যুবার পেডি এক সময় শতভাগ জনমানবশূন্য ছিল। এখনো এটি মানুষের বসবাস উপযোগী নয়। কারণ, গ্রীষ্মে এখানকার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। আবার শীতকালে তাপমাত্রা নেমে আসে শূন্য ডিগ্রিরও নিচে। এমন অবস্থায় মানুষের পক্ষে মানিয়ে নেয়া সত্যি কঠিন। আর সেই সঙ্গে ধূলি ঝড়, পানির কষ্ট ইত্যাদি তো রয়েছেই। তাই ক্যুবার পেডিতে মানুষ বসবাস করবে এটি কল্পনারও অতীত ছিল।
কল্পনাতীত এই বিষয়টিই একসময় বাস্তব হয়ে ওঠে। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ক্যুবার পেডিতে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক একটি শহর। যে শহরটি মাটির ওপরে নয় নিচে অবস্থিত। আধুনিক নগরীর  সুবিধা সংবলিত ক্যুবার পেডিতে রয়েছে রেস্তোরাঁ, বইয়ের দোকান, গির্জা, বিনোদন কেন্দ্র, ক্লাব, ব্যাংক, আর্ট গ্যালারি, মার্কেট কমপ্লেক্স। পৃথিবীর যেকোনো আধুনিক শহরের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো সবই আছে সেখানে।
তবে এখানকার এই জাঁকজমক একদিনে গড়ে উঠেনি। এর পেছনে রয়েছে মজার এক গল্প। এই ক্যুবার পেডির পাথুরে জমির সঙ্গে মিশে ছিল বিশেষ এক ধরনের রতœ। এই রতেœর নাম- ‘ওপাল’। এই জায়গাটার বিশেষত্ব প্রথম আবিষ্কার করেন উইল হাচিসন নামের চৌদ্দ বছরের এক কিশোর। ঘটনাটা ছিল ১৯১১ সালের। এই মজার আবিষ্কারের আগে এখানকার বাসিন্দা বলতে ছিল মরুভূমির সাপ, বিষাক্ত পোকামাকড়, টিকটিকি আর এমু পাখি। কিন্তু ওপালের অস্তিত্ব আবিষ্কার বদলে দিতে শুরু করল ক্যুবার পেডিকে।
ওপাল আবিষ্কারের পর বহু রতœলোভী পাড়ি জমাল এখানে। রতেœর সন্ধানে শুরু হলো খোঁড়াখুঁড়ি। আস্তে আস্তে ক্যুবার পেডির বাণিজ্যিক গুরুত্ব বাড়তে লাগলে। ক্যুবার পেডি নামকরণের পেছনেও রয়েছে ছোট্ট একটি ইতিহাস। এখানকার আদিবাসীরা মাইনারদের খোঁড়াখুঁড়ি দেখে তাদের ভাষায় জায়গার নাম দিয়েছিল কুপা সিটি। যার অর্থ মাটিতে সাদা মানুষের গর্ত। কালের বিবর্তনে সেটাই বদলে গিয়ে ক্যুবার পেডি হয়ে যায়।  সব মরুভূমিতেই দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরম আর রাতে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা থাকে। মাটির নিচে কিছুটা গেলেই অন্যরকম হয়ে যায় সবকিছু। পৃথিবী নিজেই যেন একটা প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশনার। তাই মাটির নিচে গড়পড়তা সহনশীল একটা তাপমাত্রা পাওয়া যায় সারা বছরই। অন্য দিকে খেঁিড়াখুঁড়ির জন্য মাইনারদের দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাটাতে হয় মাটির নিচে। তাই, সেখানে থাকার ঘরটাও বানিয়ে নিলে মন্দ কি! মাটির নিচে থাকলে ধূলিঝড় থেকেও বাঁচা যাবে। শুরু হলো মাটির নিচে বসতি বানানো।
এভাবেই গড়ে উঠেছে ক্যুবার পেডি। শুধু থাকার জায়গা নয়, তৈরি হয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি সমস্যার সমাধান। পানির ব্যাপারে ক্যুবার পেডির জনগণ ভীষণ সচেতন। মরুভূমিতে পানির অভাবের কারণে তারা গোসল ও ধোয়ামোছার ব্যবহƒত পানি রিসাইকেলের মাধ্যেমে সদ্ব্যবহার করে অন্যান্য কাজে। তবে এসব অসুবিধা সত্ত্বেও আজকের ক্যুবার পেডি এতটাই জমজমাট যে, অস্ট্রেলিয়ার অনেক ট্যুরিস্টই এক ঝলক দেখে যান জাগয়াটিকে। আর স্থানীয় বাসিন্দাদের তো কথাই নেই। বেশ কয়েকজন ক্যুবার পেডিবাসী অন্যত্র বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েও কিছুকাল বাইরে কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছে ক্যুবার পেডিতে। অদ্ভুত সুন্দর এই পাতাল নগরী যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।

পালকি চড়ে শ্বশুর বাড়ী যায়না কেহ আর
নাজমুল ইসলাম মকবুল :: আধুনিক এ পৃথিবীতে চলাচলের জন্য আবিস্কার হয়েছে অনেক বিস্ময়কর ও দ্রুতগামী যানবাহন। রাস্তাঘাট ও অবকাটামোগত উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপকভাবে। সে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে পল্লী গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আর তাই বেড়ে গেছে দ্রুতগামী সব যানবাহনের অসম্ভব জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা।
কর্মব্যস্থ মানুষের ব্যস্থতা যেমন বেড়েছে তেমনি যে কোন কাজ স্বল্প সময়ে স্বল্প শ্রমে দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেই মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে। আধুনিক ও নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ শেকড়ের সাথে মেশা অতীতের ঐতিহ্যবাহী অনেক জিনিসপত্রের ব্যবহার এবং রসম রেওয়াজ পরিত্যাগ করতে শুধু বাধ্য হচ্ছেনা ভুলে যেতে বসেছে এসবের ব্যবহারও। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক সেকেলে মডেলের অতি জনপ্রিয় যানবাহনও এখন আর ব্যবহার করা হয় না। ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং সময় বাচাতে অতীতের অনেক কিছুই পরিত্যাগ করতে হয়। তখন অতীত হয়ে যায় ইতিহাসের অংশ। কিন্তু আমাদের অতীত ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবেনা। অতীতকে জানা এবং পরবর্তী প্রজন্মকেও জানানোর প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। অতীতকে জেনে বা স্মরণ রেখে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সুফল লাভ হয় সহজ। আমাদের অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য সমাজ সংস্কৃতি ইত্যাদি যাতে ভুলে না যাই এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে সে সম্পর্কে অন্তত জানতে পারেন সেজন্য ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেছি ‘‘চিরায়ত বাংলা’’। চিরায়ত বাংলার হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাস ঐতিহ্যেরই একটি অংশ হচ্ছে আমাদের অতীতের বহুল ব্যবহৃত নিত্য ব্যবহার্য এবং সমাজ সংস্কৃতির অংশ অধুনালুপ্ত যানবাহন ‘‘পালকি’’।
পালকি দেখতে প্রায় মাঝারি ধরনের সিন্ধুকের মতো। সাধারনত তৈরি করা হতো বাশ ও কাঠ দিয়ে এবং উপরে দেয়া হতো কাচা টিনের কারুকার্যময় মনোরম ও নিখুত ছাউনি। কাঠের কারুকার্যখচিত বাহারি ডিজাইন থাকতো পালকীতে। ভেতরে থাকতো বসার জন্য আসন এবং চতুর্দিকে কিছু ফাকা জায়গাও থাকতো যাতে আরামে বসার বা হেলান দেয়ার জন্য বাহকের উভয় পার্শ্বে ও পেছনে বালিশ দেয়া যায়। পালকির উপরাংশের সামন ও পেছন দিকে বড় লম্বা ও মজবুত বাশ সংযুক্ত করা থাকতো যাতে সহজে দুজন বা ওজন ও অবস্থাভেদে চারজন বেহারা মিলে একসাথে কাধে বহন করে চলতে পারেন। বর বহনের বেলায় পালকিকে বিভিন্ন বাহারি রঙের রঙিন পাতলা কাগজ সুন্দর করে কেটে তাতে আটা জাতীয় জিনিস দিয়ে লাগিয়ে সাজানো হতো, যাতে এক পলকে দৃষ্টি কেড়ে নেয় সবার। কিন্তু কনে বা মহিলাদেরকে বহন করার সময় পালকির খোলা অংশ সহ চতুর্দিকে এমনভাবে পর্দা ঘেরা হতো যাতে ভেতরে কারো দৃষ্টি না পড়তে পারে কিংবা ভেতরের আরোহীনীকে যাতে কেহ দেখতে না পারেন। তখন অভিজাত এই পালকিটার নাম পরিবর্তন হয়ে নাম ধারন করে ‘‘সওয়ারী’’।
আগেকার যুগে বাংলাদেশের গ্রাম গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দূর্গম পথে জমিদার জোতদার বা মোড়লরা পালকি চড়ে যেতেন গন্তব্যে যা ছিল আভিজাত্য প্রদর্শণের অন্যতম একটি মাধ্যম। সালিশী বিচারের আসরেও বড় বড় বিচারকরা পালকি চড়ে হাজির হতেন বেশ আয়েশের সাথে। বড় বড় প্রবীন ও বয়োবৃদ্ধ মাওলানারা পালকি চড়ে ওয়াজ মাহফিলে অংশ গ্রহণ করতেন আবার পীর মুর্শিদেরাও পালকীতে চড়ে যাতায়াত করতেন তাদের ভক্ত অনুরক্ত মুরীদানদের বাড়ীতে বা মাহফিলে নিতান্ত জাকজমকের সাথে। পালকিতে গিলাফ লাগিয়ে সওয়ারীতে রূপান্তরিত করে মহিলারা যেতেন বাপের বাড়ী শ্বশুর বাড়ী সহ অন্যান্য আত্মীয়দের বাড়ীতে নাইয়র বা বেড়াতে। চলাচলের জন্য বৃদ্ধ বা অসুস্থ মহিলাদেরও একমাত্র আদর্শ বাহন ছিল পালকি। আগেকার যুগে রক্ষণশীল হিন্দু মহিলাদেরকে পালকিতে করে গঙ্গা স্নানেও নিয়ে যাওয়া হতো ঘটা করে।
পালকি বহনকারীদের বলা হয় বেহারা। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় এদেরকে বলা হতো মালি। গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ছিল তাদের বসবাস। তবে তারা পূর্ব পুরুষ থেকেই পালকি বহন বা বেহারার কাজকেই পেশা হিসেবে ধরে রাখতো এবং এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। সাধারনত চার বেহারা বহন করতেন বোঝাই পালকি। তবে পালকিতে আরোহীর ওজন কম থাকলে দুজনও বহন করতে পারতেন। বেহারাদের হাতে থাকতো মাটিতে ভর দেবার বা কষ্ট লাগবের জন্য লাঠি। বোঝা বহনের সময় তাদের পরিশ্রান্ত শরির দিয়ে অঝর ধারায় ঘাম নির্গত হয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত চলতে থাকতো তখন একেকজন বেহারাকে দেখতে মনে হতো জল্লাদের মতো। চলতে চলতে পরিশ্রান্ত হওয়ার পর তারা স্থানভেদে পালকি মাটিতে রেখে জিরিয়ে নিত। তখন বিড়ি চুরুট বা পানি পান করে শরিরটাকে কিছুটা চাঙ্গা করতো।
আগেকার গ্রাম বাংলায় সোওয়ারী পালকি ছাড়া বিয়ের কথা কল্পনাই করা যেতনা। বেহারারা বরের বাড়িতে সকাল বেলায় পালকি নিয়ে আসার পর বিয়ে বাড়ির কিশোর কিশোরিরা রকমারি পাতলা রঙিন কাটা কাগজে সাজাতো পালকিকে মনের মতো করে। উপরের চারি কোনে দিতো চারটি ঝান্ডা। কেহবা বাহারি ডিজাইনের রঙিন বেলুন ফুলিয়ে পালকিতে বাধতো সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। বর যেতেন রকমারি সাজ সজ্জায় সজ্জিত পালকি চড়ে মুখে রুমাল দিয়ে মুচকি মুচকি হেসে। গরম থেকে রেহাই পেতে পালকিতে দেওয়া হতো নিত্য নতুন ডিজাইনের বাহারি রঙের নতুন পাখা। বেহারারা কষ্ট লাগবের জন্য ধরতো বিভিন্ন ধরনের জারি গান। পালকির সামনে পিছনে বর যাত্রির দল হেটে হেটে চলতেন পথ। কনে বাড়িতে রকমারি খাবার লোভে পায়ে হাটার ক্লান্তি বরযাত্রিদের মধ্যে দেখা যেতনা। ছেলে বুড়ো সকলেই পালকির সাথে দ্রুত হেটে যেতে দেখা যেত। কোথাও কোথাও কনের বাড়ির নিকটবর্তী হলেই সকলকে আগমন সংবাদ দেবার জন্য ফুটানো হতো আতশবাজি। যাকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় গুল্লা ফুটানো। কনে বাড়িতে পৌছার পর গেইট অতিক্রম করতে শালা শালীদেরকে দিতে হতো মুচলেকা বা হাদিয়া। অবশেষে প্যান্ডেলের পার্শ্বে যাবার পর কনে বাড়ীর মুরব্বীয়ানদের অনুমতি নিয়ে পালকি থেকে নামতে হতো এবং বরের জন্য নির্ধারিত আসনেও অনুমতি নিয়ে বসতে হতো। বরপক্ষ অভিজাত হলে যাবার সময় কনের জন্য আলাদা পালকি (সওয়ারী) সাথে নেয়া হতো ফেরার পথে যাতে আরোহন করতেন নতুন কনে, আর টাকার জোর নিতান্ত কম হলে বরের সেই পালকীকেই সওয়ারীতে রূপান্তরিত করে তাতে তোলা হতো নতুন কনেকে। নতুন বর মনের সুখে হেটে হেটেই ফিরতেন বাড়ী। বাড়ীতে এসেই বেহারাদের পাওনা চুকিয়ে দেয়া হতো সাথে দেয়া হতো বিভিন্ন ধরনের বকশিশ। 
প্রাচীনকালে আভিজাত্যের প্রতিক ছিল পালকি। সাধারনত যে কেউ ইচ্ছে করলেই পালকিতে চড়তে পারতোনা। আবার পালকিতে চড়ে জমিদার, ব্রাহ্মন, বা বড়লোকের বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে বা কারো ব্যক্তিগত রাস্তা দিয়ে যেতেও বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধও ছিল। বিয়ে ছাড়াও অভিজাত মহলের যাতায়াতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত যান ছিল পালকি। পালকি চড়ে তারা গৌরব ও অহংকার করতো। প্রজা সাধারন বা নিম্ন শ্রেণীর কেহ ভয়ে পালকি চড়তে পারতোনা চড়লে জমিদার কর্তৃক শাস্তি পেতে হতো বা নিগৃহীত হতে হতো। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে আর কেহ পালকি চড়ে শশুর বাড়ি যায়না। রাজা বাদশাহ উজির নাজির আমির উমরা জমিদার মোড়লরাও আর পালকি চড়েননা। পালকির স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি। বর্তমানে বিয়েতে বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের দামী কার, পাজেরো জিপ, লুচিতা, নোহা সহ আরও অনেক ধরনের যান এমনকি ধনাঢ্য পরিবারের বিয়েতে হেলিকপ্টার পর্যন্ত দেখা যায়। এছাড়া হাতি কিংবা ঘোড়ার গাড়ি টমটমও কেহ কেহ ব্যবহার করেন শখের বশে। তাই বর্তমানে আর পালকির কদর নেই বললেই চলে। তবে যদ্দুর জানা যায় এখনও নাকি কোন কোন দূর্গম অঞ্চলে পালকির ছিটেফোটা ব্যবহার আছে।
পালকি আমাদের প্রাচিন ঐতিহ্যবাহী একটি বাহন। এ সম্পর্কিত অনেক প্রাচিন গান পুথি কবিতা প্রবাদ প্রবচন ছিল্লখ ও কিংবদন্তি রয়েছে। প্রাচিন বিয়ের গান বা গীতেও পালকির কথা আছে। আমাদের অতিত ঐতিহ্য ও সমাজ সংস্কৃতির মাঝে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে এই পালকি।
সেই ঐতিহ্যবাহী পালকি এখন আমাদের মধ্য হতে বিদায় নিয়েছে যেন অনানুষ্ঠানিকভাবেই। বেহারারা পেটের তাগিদে জড়িয়ে পড়েছে অন্য পেশায়। আমাদের হাজারো বছরের ঐতিহ্যবাহি পালকি হয়তো দেখতে হবে যাদুঘরে গিয়ে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পালকি নামক জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত বাহনকে হয়তো চিনবেইনা। এ বাহনটিকে চিনাতে হলে তাদেরকে যাদুঘরে নিয়ে যাওয়া ছাড়া হয়তো আর কোন উপায়ইবা থাকবেনা। 
লেখকঃ সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)
কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৫, ১৮৯৯ — আগস্ট ২৯, ১৯৭৬), বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবিপশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশ - দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতাগান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার এবং দাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে - কাজেই "বিদ্রোহী কবি"।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীতগজল। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং সুর করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্‌স ডিজিজে[১] আক্রান্ত হন। এর ফলে দীর্ঘদিন তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ - ১৯৪১)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১-৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ব.-২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ব.) বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার ও দার্শনিক। তিনি তাঁর 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তিনি বিশ্বকবি ও কবিগুরু নামে পরিচিত। তিনি বিশ্বের একমাত্র কবি যিনি দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা।

 

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩ - ১৯১৫)

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এর জন্ম ১৮৬৩ সালের ১০ই মে, বাংলা ১২৭০ শে বৈশাখে ময়মনসিংহ জেলার সমূয়া গ্রামের বনেদি রায় পরিবারে। বাবা কালীনাথ রায় তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য পরিচিত ছিলেন মুন্সী শ্যামসুন্দর নামে। তাঁরই দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন কামদারঞ্জন। এই পরিবারের আর এক শাখার নিঃসন্তান জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী দত্তক নিলেন তাঁর নিকট আত্মীয়ের চার কি পাঁচ বছরের এই রূপবান সুন্দর ছেলেটিকে। বাড়ি বদলের ফলে নামবদল - কামদারঞ্জন রায় হয়ে গেলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
পড়ুয়া ছেলে না হয়েও ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে পাস করলেন উপেন্দ্রকিশোর। এরপর কলকাতা এলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে। নিভৃত মফস্বল থেকে এলেন এক বিশাল সম্ভাবনার জগতে। যোগাযোগ ও যাতায়াত ঘটল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। সেখানকার ও সঙ্গীতচর্চায় অনুপ্রাণিত হলে উপেন্দ্রকিশোর। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’, শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘মুকুল’ প্রভৃতি ছোটদের কাগজ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করল শিশুসাহিত্য সৃষ্টিতে। নতুন জন্ম নিলেন ছোটদের প্রাণের লেখক, মনের লেখক অদ্বিতীয় উপেন্দ্রকিশোর!
তখনই আলাপ তাঁর চেয়ে দু’বছরের বড় সদ্য-তরুণ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। সে বন্ধুত্ব আমৃত্যু অটুট ছিল।
১৯১৩ সালের এপ্রিল, অর্থাৎ বাংলা ১৩২০ সনের বৈশাখ থেকে প্রকাশিত হতে লাগল শিশুসাহিত্যের কিংবদন্তীতুল্য পত্রিকা ‘সন্দেশ’। সম্পাদক, প্রকাশক, মুদ্রক, লেখক ও চিত্রকর স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
শুধু নিজেই লিখলেন না, ‘সন্দেশ’ পত্রিকা ঘিরে তৈরি করলেন ছোটদের নতুন ধারার নতুন লেখক-গোষ্ঠী। উপেন্দ্রকিশোরের প্রেরণায় সেকালের অনেক খ্যাতনামা লেখক লেখিকা যেমন কলম ধরলেন ছোটদের জন্য, তেমনি তাঁর পরিবারের লোকজনও। ঠাকুর পরিবারের মতো এই আর এক অবাক-করা গুণী পরিবার! বড়ো ছেলে সুকুমার তো সবার সেরা, তাঁর সঙ্গে আছেন মেয়ে সুখলতা, পুণ্যলথা। ছেলে সুবিনয়, সুবিমল। ছোটভাই কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন। সে এক জমজমাট লেখক পরিবার, যার ধারা বাংলা শিশুসাহিত্যের পরবর্তী পর্যায়কে আজও সমৃদ্ধ করে চলেছে।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০ - ডিসেম্বর ৯, ১৯৩২)

বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়।
তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তাঁর বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি, তাদেরকে ঘরে আরবী ও উর্দু শেখানো হয়। তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনস্ক ছিলেন। তিনি রোকেয়া ও করিমুননেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজী শেখান।
১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। বিয়ের পর তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে পরিচিত হন। তাঁর স্বামী মুক্তমনা মানুষ ছিলেন, রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন এবং একটি স্কুল তৈরীর জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন। রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যজগতে পা রাখেন।
তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা Sultana’s Dream। যার অনূদিত রূপের নাম সুলতানার স্বপ্ন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হলঃ পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গবিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবেনা - তা বলেছেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। তিনি ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মারা যান।

মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭ - ১৯১২)

মীর মশাররফ হোসেন ১২৫৪ বঙ্গাব্দের ২৮শে কার্তিক মোতাবেক ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বরে নদীয়া জেলার গৌরী নদীর তীরবর্তী লাহিনী পাড়া গ্রামে, মাতামহ মুন্সী জিনাতুল্লার বাটীতে, বিবি দৌলতন্নেসার গর্ভে মীর মশাররফ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মীর মুয়াজ্জম হোসেন। মর্শারফ ছিলেন তাঁর পিতার দ্বিতীয় পরে প্রথম সন্তান। রাজ-কার্যে যোগ্যতা ও পারদর্শিতার জন্য এঁরা 'মীর' উপাধি পান। প্রকৃতপক্ষে বংশ-পরিচয়ের উপাধি হল 'সৈয়দ'।


সুকুমার রায় (১৮৮৭ - ১৯২৩)

সুকুমার রায় (১৮৮৭ - ১৯২৩) একজন বাঙালি শিশু সাহিত্যিক ও বাংলা সাহিত্যে ননসেন্স্ এর প্রবর্তক। তাঁর লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা "ননসেন্স" ধরণের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড (Alice in Wonderland) ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিক-ই যাদের সমকক্ষ ।

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ - ১৯৫৪)

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯, বরিশাল - অক্টোবর ২২, ১৯৫৪, বাংলা ৬ই ফাল্গুন, ১৩০৫) একজন প্রতিভাবান বাঙালি কবি। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ, মাতা কুসুমকুমারী দাশ। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, তার ছোট ভাই অশোকানন্দ এবং বোন সুচরিতা। তিনি শিক্ষালাভ করেন প্রথমে বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে ও ব্রজমোহন কলেজে, পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে ১৯২১ সালে এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে শ্রীমতী লাবন্য গুহকে বিবাহ করেন। তাঁদের দুটি সন্তান। ১৯৩১ সালে কন্যা শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী এবং ১৯৩৮ সালে পুত্র শ্রী সমরানন্দের জন্ম হয়।

বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৪ - ১৯৫০)

বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনায় জন্মগ্রহন করেন। তাহার পিতার নাম মহানন্দা বন্দোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায় এর শ্রেষ্ঠ রচনা সমুহের মধ্যে "পথের পাঁচালী", "অপরাজিত", "আরণ্যক" অন্যতম। ১৯৫০ সালের ১লা নভেম্বর বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায় ৫৬ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬ - ১৯৪৭)

সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫ই আগস্ট, ১৯২৬ - ১৩ই মে, ১৯৪৭) বাংলা সাহিত্যের একজন কবি। পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য, মা-সুনীতি দেবী। কলকাতায় মাতামহের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়ীতে তার জন্ম। সুকান্ত ছিলেন নিবারন ভট্টাচার্যের ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়।